বিলাসভবনে স্বেচ্ছাবন্দি উত্তর কোরিয়ার ‘নিখোঁজ’ শাসক কিম জং উন?


উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন প্রায়শই যেসব বিলাসবহুল প্রমোদতরী ব্যবহার করে থাকেন, তাদের গতবিধির স্যাটেলাইট চিত্র দেখে অনুমান করা হচ্ছে, উয়োনসান এলাকায় উপকূলবর্তী একটি রিসোর্টে আপাতত আড্ডা গেড়েছেন কিম জং উন। অন্তত এমনটাই মনে করছেন সেদেশের রহস্যাবৃত সরকারের ওপর নজর রাখেন, এমন বিশেষজ্ঞরা।

কিম জং উন-এর স্বাস্থ্য এবং বর্তমান ঠিকানা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে ১৫ এপ্রিল, যখন নজিরবিহীন ভাবে তাঁর প্রয়াত ঠাকুরদা তথা উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সুং-এর জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে গরহাজির থাকেন তিনি।

তবে মঙ্গলবার NK PRO নামক একটি ওয়েবসাইট, যা উত্তর কোরিয়ার ওপর নজরদারি চালায়, জানিয়েছে যে স্যাটেলাইট ছবি দেখে মনে হচ্ছে কিম-এর ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি প্রমোদতরীর গতবিধির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, কিম এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা উয়োনসান এলাকাতেই রয়েছেন। গত সপ্তাহে আমেরিকায় অবস্থিত নর্থ ৩৮ নামে আরও একটি নজরদারি সংস্থা জানায়, তারাও স্যাটেলাইট ছবিতে দেখেছে যে কিম-এর ব্যক্তিগত ট্রেন উয়োনসানে তাঁর প্রমোদভবনে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য যে স্টেশন রয়েছে, সেখানে দাঁড় করানো রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিকারিকদের মতে, উল্লিখিত এলাকায় থাকতেই পারেন কিম, সম্ভবত নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতেই। ওই আধিকারিকরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিম-এর গুরুতর অসুস্থতার খবর নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে সঙ্গে এও যোগ করেছেন কিম-এর স্বাস্থ্য এবং বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বরাবরই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়, এবং উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে ভরসাযোগ্য তথ্য বের করা কঠিন।শেষবার কিম-এর গতবিধির হদিশ ১১ এপ্রিল প্রকাশিত একটি বৈঠকের খবরে জানায় উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যম, তবে প্রায় প্রত্যহই তাঁর চিঠি এবং কূটনৈতিক বার্তা পাঠানোর খবর প্রকাশিত হতে থেকেছে।

স্যাটেলাইট চিত্র এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের পূর্ব উপকূলে উয়োনসানে সমুদ্রের তীরে কিম-এর প্রমোদভবন চত্বরে রয়েছে বেশ কিছু অতিথি ভিলা, নিজস্ব সমুদ্রসৈকত, বাস্কেটবল কোর্ট, এবং ব্যক্তিগত রেল স্টেশন। গত বছর একটি ‘এয়ার স্ট্রিপ’ বা বিমান অবতরণের ক্ষেত্র সাফ করে সেই জায়গায় বসানো হয় একটি ঘোড়দৌড়ের ট্র্যাক। নিকটবর্তী একটি ‘বোট হাউজ’-এ রাখা থাকে কিম-এর ‘প্রিন্সেস ৯৫’ প্রমোদ তরী, যার মূল্য ২০১৩ সালেই ছিল আনুমানিক ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার।

আমেরিকার স্টিমসন সেন্টার-এর উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল ম্যাডেন জানাচ্ছেন, “এটি তাঁর প্রিয়তম বাসভবনগুলির অন্যতম।” ম্যাডেন কিম-এর এই প্রমোদভবন প্রীতির সঙ্গে তুলনা করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর ফ্লোরিডায় অবস্থিত মার-আ-লাগো রিসোর্টের প্রতি পক্ষপাতিত্বের।

ম্যাডেন বলেন, সারা দেশে কিম-এর অন্তত ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বাসভবন রয়েছে, যদিও তিনি নিয়মিত সেগুলির অর্ধেকের বেশিতে থাকেন না। “সবকটিই তাঁর হেডকোয়ার্টার হিসেবে কাজ করতে পারে, কাজেই যে কোনও একটি থেকেই তিনি দেশ চালাতে পারেন।”

উয়োনসানের বাড়ির চত্বরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সাজানো, তবে এটির অবস্থানগত সুবিধাও রয়েছে। চাইলে এখান থেকে উপকূল ধরে অন্যান্য স্থানে সফর করতে পারেন কিম, অথবা নিজের ট্রেনে চেপে বা শুধুমাত্র তাঁর ও তাঁর পরিবার এবং কিছু শীর্ষ আধিকারিকের ব্যবহারের জন্য তৈরি হাইওয়ে ধরে দ্রুত ফিরতে পারেন রাজধানী পিয়ংইয়াং-এ, বলছেন ম্যাডেন।

কিম পরিবারের কাছে উয়োনসানের প্রতীকী গুরুত্বও কম নয়। জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন শেষে ১৯৪৫ সালে এখানেই সোভিয়েত বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম অবতরণ করেন কিম ইল সুং, দেশ স্বাধীন করে উত্তর কোরিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, উয়োনসানই কিম জং উন-এর জন্মস্থানও, যদিও এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।

পাশাপাশি উয়োনসান এলাকা হয়ে উঠেছে কিম-এর অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ের প্রতীক। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যে কৌশল তিনি নিয়েছেন, তা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পর্যটন, এবং পারমাণবিক অস্ত্রের একটি মিশেল। সাড়ে তিন লক্ষ অধিবাসীর এই শহরটিকে তিনি নতুন করে গড়তে চান, কোটি কোটি ডলারের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে চান।

সাম্প্রতিক কালে বারবার বিলম্বিত হয়েছে এই প্রকল্প, যার একটা কারণ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক এবং মিসাইল কর্মসূচীর জেরে দেশের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানানোর উপায় নেই উত্তর কোরিয়ার।

No comments:

Post a Comment

Welcome To My Blog.